খালি চোখে যা দেখি আমরা, সেটাই কি বিশ্বাস ও বাস্তবতার সর্বোচ্চ কথা? না । একবিংশ শতাব্দীর অনুসন্ধিৎসু সমাজ এ-ধারণা বদলে দিয়েছে। যাপিত জীবনের পরতে পরতে কপাল কুঁচকে তাকালেই থমকে যেতে হচ্ছে—কী হচ্ছে এখানে; কে-ইবা করছে! ব্যক্তিজীবনের এমন অসংখ্য কৌতূহল আমাদের ভাবতে শেখায় সমাজ ও রাষ্ট্রের বিবিধ প্রশ্নের প্রকৃত জবাব নিয়ে।
দেশ, রাজ্য, সমাজ ও বিশ্বের ধারাবাহিক নিয়ন্তাদের ভেতরের কথা পড়তে পড়তে জানা যায়— আড়ালে এই সমগ্র জগতের নিয়ন্ত্রণ গুটিকতক মানুষের হাতে। উঠে আসে একটি গুপ্ত সংগঠনের নাম—ইলুমিনাতি।
অনেকদিন পর্যন্ত বাঙালি মুসলিমসমাজ ইলুমিনাতি-প্রশ্নে নিস্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। তবে আশার কথা হলো, অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ইলুমিনাতি সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেশ লক্ষ্যণীয়। স্যোস্যাল মিডিয়ায় মাঝেমধ্যেই এ ব্যাপারে লেখা চোখে পড়ে।
তো সেই যাই হোক আজকে আমরা জানবো ইলুমিনাতি কি? এবং ইলুমিনাতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, তাহলে দেরী না করে চলুন জেনে নেওয়া যাক ইলুমিনাতি কি।
ইলুমিনাতি কি
১৮ শতকের কথা। ইউরোপে তখন ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের রাজত্ব চলছে। ক্যাথলিজমের বিরুদ্ধে তখন কারও মুখ খোলার দুঃসাহস ছিল না। বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু গোপন সংস্থা গড়ে উঠলেও সমাজবিপ্লব বা বড় কোনো আন্দোলনে তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান ছিল না।
সে শতাব্দীতেই ১৭৭৬ সালে জার্মানির দক্ষিণপূর্ব বৃহত্তম রাজ্য ব্যাভারিয়া থেকে যাত্রা শুরু করে ‘ইলুমিনাতি’। ব্যাভারিয়ার ইঙ্গলস্ট্যাড ইউনিভার্সিটির খ্রিস্টীয় আইন ও ব্যবহারিক দর্শনবিদ্যার প্রফেসর ছিলেন অ্যাডাম ওয়েইশপ্ট [Adam Weishaupt] (1748-1830)।
তার হাত ধরেই সূচিত হয় আধুনিক ইলুমিনাতির যাত্রা। ১৭৭৬ সালের পহেলা মে চারজন ছাত্রসহ এ-যাত্রা শুরু করেন তিনি। অথচ সে সময় ইঙ্গলস্ট্যাড ইউনিভার্সিটি ছিল সম্পূর্ণ জেসুইট প্রভাবিত। তারা প্রথাগতভাবে খ্রিস্টীয় সকল অনুশাসন মেনে চলত দ্বিধাহীনভাবে।
প্রথম ইলুমিনাতির লোগো হিসেবে নির্ধারণ করা হয় গ্রিক জ্ঞানদেবী মিনারভার পেঁচা।
ইলুমিনাতির শব্দের অর্থ
ইলুমিনাতি শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো—এমন একদল লোক, যারা কোনো বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। ইলুমিনাতি সদস্যদের ভাষ্যমতে, তারা কুসংস্কারমুক্ত (মূলত ধর্মীয় বন্ধন ও আচার-প্রথামুক্ত) এক নতুন পৃথিবী প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে।
তারা বিশ্বময় One World Order প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এই ইলুমিনাতি অন্য ভাষায় ‘ইলুমিনাতি অব ব্যাভারিয়া’ অথবা ‘ইলুমিনাতি অর্ডার’ নামেও পরিচিত।
প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডামের পরিচয়
ইলুমিনাতির প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডাম ছিল একজন ইহুদি ধর্মযাজকের ছেলে; কিন্তু সে নিজেকে পরিচয় দিত একজন ক্যাথলিক খ্রিস্টান হিসেবে।
তার ইলুমিনাতি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল, খ্রিস্টধর্মের বিনাশ, রাজতন্ত্রের বিনাশ, বিশ্ব সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, পারিবারিক বন্ধন এবং বিবাহব্যবস্থার উচ্ছেদ, উত্তরাধিকার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার রদ করা এবং সর্বোপরি জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলা।
অ্যাডাম ওয়েইশপ্টের পরিবারের সঙ্গে জেসুইট সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ছিল। জেসুইট সম্প্রদায়টি অকাল্ট এবং ভারতীয় যোগশাস্ত্র চর্চা করত বলে তারা ছিল রহস্যময়।
অনেকের মতে জেসুইট সম্প্রদায়ের গুহ্য প্রতীক এবং সংকেত পরবর্তীকালে অ্যাডাম তার প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। অ্যাডাম ইলুমিনাতি গোষ্ঠীকে ফ্রিম্যাসনারি গোষ্ঠীর ‘চূড়ান্ত স্তর’ হিসেবে দেখতেন।
রিলেটেডঃ দর্শন কাকে বলে? দর্শন কি? দর্শনের সংজ্ঞা ২০২৩
ইলুমিনাতির জন্মস্থান
বর্তমান জার্মানির মানচিত্রে ইঙ্গলস্ট্যাড শহরের অবস্থান। এখানেই অষ্টাদশ শতকের শেষে ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল। অষ্টাদশ শতকে ইঙ্গলস্ট্যাড ছিল ব্যাভারিয়ার অন্তর্গত। প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডামও জন্মেছিলেন এখানেই। অ্যাডামের জন্মস্থান হওয়ায় এই ছোট্ট শহরটি একসময় আলোচনায় উঠে আসে।
জন্মদিন নির্ধারণের নেপথ্যে
অ্যাডম ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাদিবস হিসেবে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের ১ তারিখকে বেছে নিয়েছিল। কারণ, ওই দিনটি ছিল আদিম প্যাগানদের পবিত্র দিন।
অনেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ফ্রিম্যাসনারি এবং ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর পরিকল্পিত ‘প্রজেক্ট’ বা ‘এজেন্ডা’ হিসেবে দেখেন। মে মাসের ১ তারিখ কমিউনিস্টদের এক বিশেষ দিন।
তাছাড়া ওই ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দই American Declaration of Independence ঘোষিত হয়েছিল এবং মার্কিন ওই ঐতিহাসিক ঘটনার নায়কদের অনেকেই ছিলেন ফ্রিম্যাসন—যারা ইউরোপ থেকে অষ্টাদশ শতকে ‘নতুন বিশ্বে’ গিয়েছিল।
ইলুমিনাতি গোষ্ঠীর ভেতরে অ্যাডাম ছদ্মনাম ধারণ করেছিলেন। অ্যাডামের ছদ্মনাম ছিল ‘স্পার্টাকাস’। অ্যাডাম বলেছিল, ইলুমিনাতি বিশ্বময় One World Order প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
ইলুমিনাতির উপাস্য
ইলুমিনাতি মূলত “লুসিফার”-এর (শয়তানের) পূজা করে। তারা কোনো কিছুকে ভয় পেতে বারণ করে। তারা চায়—মানুষ বাধাহীনভাবে সব কাজে মেতে উঠুক; এমনকি যদি তা অযাচারও হয়। তারা বরং অশ্লীলতার বিস্তার চায়।
কারণ, এতে সভ্যতা খুব দ্রুত ধ্বংস হবে। যার ফলে তারা মানুষকে বশে আনতে পারবে। তাই তারা চেষ্টা করে মানুষকে বেশি করে যৌনতার প্রতি আকর্ষিত করতে। তারা মানুষকে বশে আনার জন্য এমনভাবে কৌশল প্রয়োগ করে, যাতে মানুষ খুব সহজেই কাবু হয়ে যায়। বলতে গেলে শয়তান বা ফেরাউনের মাস্টার প্ল্যানিংয়ের মতো।
যেমন প্রথমদিকে শয়তান এসে হাওয়া আলাইহাস সালামকে বলেছিল, ‘আল্লাহ তো আপনাকে এ ফলটি খেতে নিষেধ করেছেন; কিন্তু দেখতে তো নিষেধ করেন নি। আসেন, একটু দেখেন।’ এরপর ধীরে ধীরে গন্ধ শোঁকার জন্য উৎসাহিত করে। তারপর ছুঁয়ে দেখতে আকর্ষিত করে এবং সবশেষে তা খাইয়েই ছাড়ে। শয়তান কিন্তু সরাসরি তাকে খেতে বলে নি। শয়তান তার প্ল্যান বাস্তবায়ন করেছে ধীরে ধীরে, সূক্ষ্ম কৌশলের মাধ্যমে।
ফেরাউনের কাছে ক্ষমতা যাওয়ার পর তার ইচ্ছা জাগে খোদা বলে পরিচিত হওয়ার। সে তার বিজ্ঞ বন্ধুর কাছ থেকে এ বিষয় পরামর্শ চাইলে সে বলে, সমাজের জ্ঞানচর্চা বন্ধ করে দিতে হবে। ফেরাউন পরামর্শ অনুসারে তা-ই করে। ফলে বনি ইসরাইল জাতি কিছু বছর পর মূর্খ জাতিতে পরিণত হয়। তখন সেই মূর্খ সমাজকে ফেরাউনের বশে আনতে পরবর্তী সময়ে মোটেও বেগ পেতে হয়নি।
ইলুমিনাতির সদস্যরা
‘ইলুমিনাতি’ একটি রহস্যপূর্ণ গোপন সংগঠন। এর সদস্যবৃন্দের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যাংকার, রাজনীতিবিদ এবং বিশ্ব মিডিয়ার রাঘব বোয়ালরা। ইলুমিনাতি একটি গুপ্তসভা, যা বিশ্বের সকল দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে দেশে অত্যাচারী সরকারব্যবস্থা কায়েম করে দেশ ও জাতি নির্বিশেষে মানুষের ধর্মীয়, মানবিক, সামাজিক এমনকি ব্যক্তিগত অস্তিত্বের ওপর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা।
তথ্যসুত্রঃ ইলুমিনাতি
লেখকঃ আব্দুল কাইয়ুম আহমেদ