পবিত্র কোরআন ও হাদিসে অসংখ্যবার বলা হয়েছে দুনিয়াতে বিপদে আপদে, দুঃখে কষ্টে সর্বদা আল্লাহ তাওয়ালার জিকির ও দোয়া করতে, তাতে আমাদের রব খুশি হন এবং আমাদের দোয়া কবুল করে আমাদের বিপদ আপদ দূর করে দেন। তবে দোয়া কবুল হাওয়ার অনেক নিয়ম কানুন রয়েছে।
এই লেখাতে আমরা বিস্তারিত জানবো, দোয়া কি? দোয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ? ও দোয়া কবুল হওয়ার বিস্তারিত নিয়মাবলি। তাহলে চলুন দেরী না করে দেখে নেই।
দোয়া কি?
দোয়া হল دُعَاء বহুবচন: আদ ইয়াহ, আরবি: أدْعِيَة , কুরআন মজীদের পরিভাষা। এর অর্থ ডাকা, আহবান, প্রার্থনা। মহান রব্বুল ‘আলামীনকে ডাকা ও তার সাহায্য লাভের প্রার্থনাকে বলা হয় দোয়া। দোয়া প্রত্যেক মানুষের সহজাত স্বভাব। জীবনের উন্নতি লাভ বা বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য প্রত্যেক মানুষই কোনো শক্তিমান সত্তাকে ডাকে, তার সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা করে।
যাদের জীবনে ঈমান নসীব হয় নি, তারা আল্লাহ-ভিন্ন অন্য শক্তির কাছে এই সাহায্য চায়। আশা পুরণ বা বিপদ মোচনের জন্য তারা এসবকে এমনভাবে ডাকে, যেভাবে অদ্বিতীয় খোদা আল্লাহ তাআলাকে ডাকা উচিত। এ কাজ স্পষ্ট শিরক, এমন গুনাহ- যা আল্লাহ কোনদিন মাফ করবেন না ।
নিঃসন্দেহে আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করেন না, যে তার সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করে। আর তিনি এর চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের পাপ, যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে লোক আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করল সে এক জঘন্য উদ্ভট পাপ আরোপ করল। -(সূরা নিসা: ৪: ৪৮ )
এই জঘন্য উদ্ভট পাপের স্বরূপ বুঝানোর জন্যে কুরআন মজীদে একটি উপমা দেয়া হয়েছে প্রতিমা ও মাছির প্রসঙ্গ এনে ।
হে মানবমন্ডলী! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে, তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোনো: তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এ কাজের জন্য তারা সবাই একত্রিত হলেও। এবং মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেয় তাও তারা এর কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছ থেকে প্রার্থনা করা হচ্ছে (অর্থাৎ উপাসক ও উপাস্য উভয়ে) কতই দুর্বল। -(সূরা হজ্ব: ৭৩)
কোনো অশরীরি শক্তি বা প্রতিমার কাছে বিপদ মোচন বা আশা পুরণের প্রার্থনা করার চেয়ে মূর্খতা আর কিছুই হতে পারে না। পূজা হিসেবে দেয়া খাদ্য পানীয়ের প্রাসাদ খাওয়ার শক্তি যে প্রতিমার নাই; যদি এমন হয় যে, এসব খাদ্যের গন্ধে মাছি এসে পূজনীয় প্রতিমার গায়ে বসল; অথচ সেই মাছি তাড়ানোর শক্তিও প্রতিমার নাই, সেগুলোকে খোদায়ী শক্তির অধিকারী মনে করে প্রণাম করা, পূজো দেয়া, আশা পুরণ বা বিপদ মোচনের জন্যে সাহায্য চাওয়া ও আশ্রয় প্রার্থনা করা স্বয়ং মানুষের জন্যই চরম লজ্জাকর।
তাতে মানুষ প্রকারান্তরে নিজের ও মানব জাতির মর্যাদাকে পদদলিত করে। আর তা মহান স্রষ্টা, যিনি মানুষকে সৃষ্টির সেরা, আশরাফুল মাখলুকাত ও পৃথিবীতে আপন প্রতিনিধি করে পাঠালেন, তাকে অপমাণিত করার শামিল।
এ কারণে শিরক বা আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার সাব্যস্ত করা অমার্জনীয় অপরাধ, যা আল্লাহ তাআ’লা কিছুতেই মাফ করবেন না এবং পরিণামে জাহান্নাম অবধারিত।
পক্ষান্তরে যারা ঈমানদার, তারা আশা পুরণ ও বিপদ মোচনের একমাত্র মালিক হিসেবে আল্লাহকেই জানে, আল্লাহকেই ডাকে । আল্লাহ বলেন:
“তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। (অর্থাৎ তোমরা আমার কাছে চাও, আমি দেব)।” -(সূরা মু’মিন: ৪০: ৬০)
মানুষ দুনিয়ার কোনো দানশীলের কাছে চাইলে হয়ত দেয়, বারবার চাইলে বিরক্ত হয়। জেদ করলে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আল্লাহ; আল্লাহর কাছে মানুষ যত চায়, তিনি তত খুশি হন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী জুতার ফিতার মতো তুচ্ছ জিনিষও ভাল টেকসই হওয়ার জন্য দোয়া করলে আল্লাহ খুশি হন। তার কাছে চাইতে সময় সুযোগ লাগে না। তিনি চিরজীবন্ত, সর্বজ্ঞ, সর্বশ্রোতা। তাঁর দান অফুরান ।
কুরআন মজীদের উপরোক্ত আয়াত নাযিল হবার পর সাহাবায়ে কেরামের মাঝে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। বান্দা ডাকলে সাথে সাথে আল্লাহ সাড়া দেবেন-এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে। প্রশ্ন দেখা দেয়, তাকে কীভাবে ডাকব? কীভাবে ডাকলে শুনবেন তিনি? তিনি কি দূরে, অনেক উপরে? জোরে চিৎকার দিয়ে ডাকব? নাকি কাছে, কানে কানে বলার মতো বলব। কাছে বলতে কোথায়? মহল্লার মসজিদে না আরো নিকটে। এই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ। বলেছেন:
আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জানতে চায়, আমি তো নিকটেই। আহবানকারীর আহবানে আমি সাড়া দেই। অতএব তাদেরও উচিত আমার ডাকে সাড়া দেয়া (আমার আদেশ নিষেধ বাস্তবায়ন করা) আর আমার উপর দৃঢ় ঈমান রাখা । -(সূরা বাকারা: ২ঃ ২ঃ ১৮৬)
আয়াতের বাচনভঙ্গি কত চমৎকার। বলেছেন, ‘আমার বান্দারা যখন আপনার কাছে আমার ব্যাপারে জানতে চায়’। মনে হবে পরের বাক্যটি এভাবে হলেই কিনা সুন্দর হত ‘আপনি বলুন যে, আমি নিকটেই”। কিন্তু না- ‘আপনি বলুন কথাটি এখানে উহ্য।
বলেছেন “ আমি তো নিকটেই” । আল্লাহকে যে ডাকে তিনি তাঁর একান্ত কাছে— এ কথা বুঝাতেই এই বাচনশৈলী। অন্য আয়াতে আল্লাহ বান্দার কতখানি কাছে তাও বুঝিয়ে বলা হয়েছে। তিনি কি মহল্লার মসজিদে বা বাড়ির গলিতে কিংবা উঠানের দূরত্বে? নাহ্, তিনি বান্দার একান্তই নিকটে। মানুষের সবচেয়ে নিকটে তার শরীর। আর শরীরের কোন অঙ্গটি মানুষের সবচে নিকটে তা চিন্তা করে বের করা অসম্ভব।
আল্লাহ বলেছেন: “তার গর্দানের যে শাহরগ, তার চেয়েও তার অধিক নিকটে আমি”। (সূরা হজ্ব: ৭৩) = সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহী।
দোয়া করার কতিপয় বৈশিষ্ট্য
- ধৈর্য এবং ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহ্র সুন্দরতম নামের অসীলায় বিনয়ের সাথে নীরবে দোয়া করা।
- ওযূ করে ক্বিবলামুখী হয়ে নেক আমলের মাধ্যমে গভীর আগ্রহের সাথে দোয়া করা এবং কবুলের জন্য ব্যস্ত না হওয়া ।
- হারাম খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র বর্জন করে দু’রাক’আত ছালাতের পর আল্লাহ্ প্রশংসা এবং নবীর উপর দরূদ পড়ে দোয়া করা ।
- অপরাধ স্বীকার করে বিশুদ্ধ নিয়তে দোয়া করা।
দোয়া করার উত্তম সময়
কিছু নির্দিষ্ট সময়ে দোয়া কবুল হওয়ার বেশি সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো হলঃ
১। আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দোয়া।
২। ফরয সালাতের পরের দোয়া।
৩। সিজদারত অবস্থায় দোয়া।
৪ । জমজমের পানি পান করার সময়ের দোয়া।
৫। যে স্থানে যিকির এবং কুরআনের আলোচনা করা হয় ।
৬। তাহাজ্জুদ নামাযের সময়ের দু’আ।
৭। সাহরীর সময়ে দোয়া।
৮। ইফতারের সময়ে দোয়া।
৯। প্রতি শুক্রবার এবং শনিবার আসর নামায থেকে মাগরিব নামাযের আগ
পর্যন্ত দোয়া৷
১০। বৃষ্টি বর্ষণের সময়ের দোয়া।
১১। মোরগ ডাকার সময়ের দোয়া।
১২। সালাতের ভেতর সূরা ফাতেহা পাঠ শেষে আমীন বলার সময় দোয়া।
১৩। রমযানে কদরের রাতের দু’আ।
১৪ । যিলহজ মাসে প্রথম দশ দিনের দোয়া।
দোয়া কবুল হওয়ার শর্ত
দোয়া কবুলের জন্যে যে জিনিষগুলি অবশ্যই মনে রাখতে হবে তা হলঃ
১। হারাম খাদ্য ও পোশাক থেকে নিজেকে বিরত রাখা ।
২। হারাম উপার্জন থেকে বিরত থাকা ।
৩। সুর করে দোয়াপাঠ থেকে বিরত থাকা ।
৪ । ছন্দবদ্ধ দোয়া থেকে বিরত থাকা।
৫ । অন্তর থেকে দোয়াপাঠ করা ।
৬। দু’আর ফলাফল লাভের জন্য তাড়াহুড়া না করা ।
৭। সুখ-দুখ সর্ব অবস্থায় দোয়াকরা ।
দোয়া কবুল হওয়ার উত্তম স্থান
যেসব স্থানে দোয়া কবুল হয়ে থাকে সেগুলি হচ্ছেঃ
১। কাবাঘরের ভেতরে দোয়া করা ।
২। কাবাঘর তাওয়াফ করার সময় দোয়া করা ৷
৩। সাফা পাহাড়ের উপর দোয়া করা।
৪ । মারওয়া পাহাড়ের উপর দোয়া করা ।
৫। সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী স্থানে দোয়া করা ।
৬। আরাফাতের দিন আরাফার ময়দানে দোয়া করা ।
৭। মুযদালিফায় মাশআরুল হারাম নামক জায়গায় দোয়া করা ৷
৮। হজের সময় ১১ ও ১২ যিলহজ তারিখে ছোট জামারায় পাথর নিক্ষেপের পর দোয়া করা ৷
যাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন
১। গৃহহীন ও অসহায় মানুষের দোয়া।
২। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের দোয়া।
৩। শিক্ষকের দোয়া।
৪ । বৃদ্ধদের দোয়া।
৫। অসুস্থ ব্যক্তির দু’আ।
৬। মুসাফির বা ভ্রমণকারীর দোয়া।
৭। একজনের অনুপস্থিতিতে অপরের দোয়া।
৮। রোযাদারের দোয়া।
৯ । একজন হাজীর বাড়ি ফেরার পূর্ব পর্যন্ত দোয়া।
১০। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে নির্যাতিত ব্যক্তির দোয়া।
১১। ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রনায়কের দোয়া।
শেষ করার আগে আমাদের প্রিয় নবীর একটা হাদিস দিয়ে শেষ করতে চাই,
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি আল্লাহ্র নিকট দোয়া করে এবং সে দোয়ার মধ্যে পাপ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার কথা না থাকে, তবে আল্লাহ উক্ত দোয়ার বিনিময়ে তাকে তিনটির যেকোন একটি দান করেন।
- তার দোয়া দ্রুত কবুল করেন অথবা
- তার প্রতিদান আখেরাতে প্রদানের জন্য জমা রাখেন অথবা
- তার থেকে অনুরূপ আরেকটি কষ্ট দূরীভূত করেন।
একথা শুনে ছাহাবীগণ বললেন, তাহ’লে আমরা বেশী বেশী দোয়া করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ আরও বেশী দোয়া কবুলকারী (আহমাদ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২১৫২)।