বিবাহ একটি সামাজিক অনুষ্ঠান, যার মাধ্যমে দুজন অপরিচিত মানুষকে সমাজ বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ দিয়ে থাকে। কমবেশি সবাই আমারা বিবাহ নামক পবিত্র সামাজিক প্রথার সাথে পরিচিত। আর আমরা যারা মুসলিম তারা সবাই ইসলামিক নিয়মকানুনে চলতে পছন্দ করি। তো আল্লাহ তায়ালার আদেশ নিষেধ মানাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
পবিত্র কোরআনে ও বিভিন্ন হাদিসে এসেছে স্ত্রী সহবাসের আগে সহবাসের দোয়া পাঠ করার। যেনো শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মানুষের প্রধান শত্রু হচ্ছে শয়তান, স্ত্রী সহবাসের আগে স্ত্রী সহবাসের দোয়া পাঠ করলে শয়তান দূরে থাকে, সওয়াব হয়, আগত সন্তান শয়তানের নেতিবাচক প্রভাবমুক্ত থাকে। (বুখারি, হাদিস : ৩২৮৩)
তাই সহবাসের আগে সহবাসের নিয়মকানুন, সহবাসের দোয়া, সহবাসের আগে নামজ, ও নেক সন্তান দানের জন্যে দোয়া জানা খুব জরুরী। আজকের লেখাতে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানবো।
দোয়া কি?
দোয়া অর্থ চাওয়া, প্রার্থনা করা ইত্যাদি। অর্থাৎ সাধারণ ব্যক্তি কর্তৃক বড় কোন ব্যক্তির নিকট ভয়-ভীতি সহকারে বিনয়ের সাথে নিবেদন করা। দো‘আ অর্থ ডাকা। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব’ (মুমিন ৬০)।
দো’আ অর্থ ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন, “তুমি আল্লাহ ব্যতীত এমন কারো ইবাদত করো না, যে তোমার ভাল-মন্দ কিছুই করতে পারে না’ (ইউনুস ১০৬)। দো’আ অর্থ বাণী । আল্লাহ বলেন, ‘সেখানে তাদের বাণী হ’ল, “হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র; আর তাদের শুভেচ্ছা হ’ল সালাম’ (ইউনুস ১০)।
দো’আ অর্থ আহ্বান করা। আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করবেন, অতঃপর তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে চলে আসবে’ (ইসরা ৫২)। দো’আ অর্থ অনুনয়- বিনয় করা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সাহায্যকারীদেরকে বিনয়ের সাথে ডাক’ (বাক্বারাহ ২৩)।
দো’আ অর্থ প্রশংসা সহকারে ডাকা । আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমি আল্লাহ্র প্রশংসা করি অথবা রহমানের প্রশংসা করি’ (ইসরা ১১০; মির’আত, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩৯৪)।
সহবাসের দোয়া কি?
স্ত্রী সহবাসের দোয়া জানার আগে এটা জানা জরুরি সহবাসের দোয়া আসলে কি? সহবাস হল স্বামী ও স্ত্রীর মিলন। স্বামী ও স্ত্রী একে অপরের সাথে মিলিত হওয়ার আগে যে দোয়া পাঠ করা হয় তাকেই সহবাসের দোয়া বলে।
আরো সহজ করে বললে “যে দোয়া স্ত্রী স্বামীকে ও স্বামী স্ত্রীকে স্পর্শ করার আগে শয়তানের কুপ্ররোচনা থেকে মুক্তির জন্যে পাঠ করা হয় সেই দোয়াই হল সহবাসের দোয়া”
সহবাসের দোয়া
সহবাসের আগে স্বামী স্ত্রী উভয়কেই নিচের স্ত্রী সহবাসের দোয়াটি পড়া সুন্নত। এতে মিলন হবে পবিত্র ও দীর্ঘ।
বাংলা উচ্চারণ: বিসমিল্লা-হি আল্লা-হুম্মা জান্নিবনাশ্ শাইত্বা-না ওয়া জান্নিবিশ শাইত্বা-না মা রাঝাক্বতানা।
আরবী উচ্চারণ: بِسْمِ اللَّهِ ، اللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ ، وَجَنِّبْ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا
বাংলা অর্থ: ‘আল্লাহ্র নামে আরম্ভ করছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে শয়তান থেকে দূরে রাখ এবং আমাদের এ মিলনের ফলে যে সন্তান দান করবে তাকেও শয়তান থেকে দূরে রাখ’। মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২৩০৪ ।
ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউ তার স্ত্রীর সাথে মিলনের পূর্বে যদি উক্ত দো’আ বলে তারপর তাদের কিসমতে কোন সন্তান থাকলে শয়তান তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না ৷
বিবাহিতদের জন্যে দোয়া
কোন বিবাহিত দম্পতির জন্যে নিচের দোয়াটি পড়তে হবে।
বাংলা উচ্চারণ: বারাকাল্লাহু লাকা ওয়া বারাকা আলায়কা ওয়া জামায়া বায়নাকুমা ফি খায়র।
বাংলা অর্থ: আল্লাহ তোমাকে বরকত দান করুন, তোমার প্রতি বরকত নাজিল করুন এবং কল্যাণের সাথে তোমাদেরকে একত্রে রাখুন। (আবু দাউদ, হা/২১৩২, তিরমিজি, হা/১০৯১)
রিলেটেডঃ গর্ভাবস্থায় সহবাস করার নিয়ম । ২০২৩
নতুন স্ত্রীর জন্যে দোয়া
বিয়ের পর নতুন স্ত্রীর জন্যে স্ত্রী সহবাসের দোয়াটি পড়তে হবে।
বাংলা উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খায়রাহা ওয়া খায়রা মা জুবিলাতহা আলায়হি ওয়া আউযুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা জুবিলাতহা আলায়হ।
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট তার মঙ্গল চাই এবং যার ওপর আপনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, তারও মঙ্গল চাই। আর আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাই তার অনিষ্ট হতে এবং যে অনিষ্ট দিয়ে তাকে সৃষ্টি করেছেন তা হতে। (আবু দাউদ, হা/২১৬২, ইবনে মাজাহ, হা/২২৫২, জামেউস সগির, হা/৩৪২, মিশকাত, হা/২৪৪৬)
বাসর রাতে স্বামী-স্ত্রী এক সঙ্গে সালাত আদায়ের পর দোয়া
অধিক সময় সহবাসের উপায় হলো স্ত্রী সহবাসের নিয়ম মেনে চলা, এবং আল্লাহর দরবারে অধিক সময় সহবাসের দোয়া করা, এতে আল্লাহ তাওয়ালা খুশি হবেন, শয়তান থেকে রক্ষা করবেন, এবং মিলন হবে অনেক দীর্ঘ ও আনন্দময়। মিলন শেষে নামাজ পড়বেন এবং নিচের দোয়াগুলি পড়বেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যখন মহিলা তার স্বামীর কাছে আসবে, তখন স্বামী ছালাত আদায়ের জন্য দাঁড়াবে এবং তার পিছনে তার স্ত্রীও দাঁড়াবে এবং উভয়ে দু’রাক’আত ছালাত আদায় করার পর বলবে,
বাংলা উচ্চারণ: আল্ল-হুম্মা বা-রিকলী ফী আলী ওয়াবা-রিকলী ফীইয়া, আল্ল-হুম্মার ঝুকুহুম মিন্নী ওয়ারঝুকুনী মিহুম। আল্ল-হুম্মাজ্মা’ বাইনানা মা- জমা—তা ফী খইরিন, ওয়া ফাররিকু বাইনানা- ইযা- ফার্রকৃতা ফী খইর ।
বাংলা অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমাদের স্বার্থে আমার পরিবারে বরকত দিন এবং আমার মাঝে পরিবারের স্বার্থে বরকত দিন। হে আল্লাহ! তাদেরকে আমার পক্ষ থেকে রিযিক দান করুন এবং আমাকে তাদের পক্ষ থেকে রিযিক দান করুন। হে আল্লাহ! যে কল্যাণ আপনি জমা করেছেন তা আপনি আমাদের মাঝে জমা করুন। আর যদি আপনি কল্যাণকে পৃথক করেন তাহ’লে আমাদের মাঝে পৃথক করুন’ (আলবানী, আদাবুয যিফাফ ৯৬ পৃঃ)।
বাসর ঘরে পাঠ করার দোয়া
‘আমর ইবনু শো‘আইব তার পিতা হ’তে তার দাদার মাধ্যমে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ কোন নারীকে বিবাহ করে অথবা কোন খাদেম ক্রয় করে তখন সে যেন বলে,
বাংলা উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস্আলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরামা জাবাল্লাহা ‘আলাইহি ওয়া আ’উযুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররিমা জাবাল্লাহা ‘আলাইহ ।
বাংলা অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট তার মঙ্গল ও যে মঙ্গলের উপর তাকে সৃষ্টি করেছ তা প্রার্থনা করছি। আর তার অমঙ্গল ও যে অমঙ্গলের উপর তাকে সৃষ্টি করেছ তা থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি’ ৷ আবুদাঊদ, ইবনু মাজাহ, সনদ হাসান, মিশকাত হা/২৪৪৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৩৩৩।
নেক সন্তান পাওয়ার জন্যে দোয়া
নেক সন্তান পাওয়ার জন্যে নিচের দোয়াগুলি স্ত্রী সহবাসের আগে নিয়মিত পড়তে হবে।
১)
উচ্চারণ: রাব্বি হাবলি মিনাস সলিহিন ।
অর্থ: হে আমার রব! আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন। (সূরা সাফফাত-১০০)
২)
উচ্চারণ : রাব্বি লা তাজারনি ফিরদান ওয়া আনতা খাইরুল ওয়ারিসিন ।
অর্থ: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সন্তানহীন করে রেখো না, আর তুমি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। (সূরা আম্বিয়া-৮৯)
দোয়ার ফজীলত
দো’আ অর্থ ডাকা, কিছু চাওয়া, প্রার্থনা করা প্রভৃতি। বিনয়ের সাথে আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা করা হ’ল দো’আ। আল্লাহ বলেন, তোমরা আমার নিকট দো’আ কর, আমি তোমাদের দো’আ কবুল করব’ (সূরা মুমিন ৬০)।
নবী করীম (ছাঃ) বলেন, কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি আল্লাহ্র নিকট দো’আ করে এবং সে দো’আর মধ্যে পাপ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার কথা না থাকে, তবে আল্লাহ উক্ত দো‘আর বিনিময়ে তাকে তিনটির যেকোন একটি দান করেন।
- তার দো’আ দ্রুত কবুল করেন অথবা
- তার প্রতিদান আখেরাতে প্রদানের জন্য জমা রাখেন অথবা
- তার থেকে অনুরূপ আরেকটি কষ্ট দূরীভূত করেন।
একথা শুনে ছাহাবীগণ বললেন, তাহ’লে আমরা বেশী বেশী দো’আ করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ আরও বেশী দো’আ কবুলকারী (আহমাদ, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২১৫২)।
দো’আ করার আদব বা বৈশিষ্ট্য
দো’আ করার কিছু আদব বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা পালন করা আবশ্যক ।
যেমন-
(১) হারাম খাওয়া, পান করা ও পরিধান করা হ’তে বিরত থাকা: রাসূলুল্লাহ (বাঃ) বলেন, ‘খাদ্য, পানি ও পোষাক হারাম হ’লে দো’আ কবুল হয় না’ (মুসলিম, মিশকাত, হা/২৭৬০; ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়)।
(২) খালেছ নিয়তে অর্থাৎ অন্তরে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে একনিষ্ঠভাবে দো’আ করা: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, “নিশ্চয়ই কর্ম নিয়তের উপর নির্ভরশীল’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/১)।
(৩) নেক আমল পেশ করে দো’আ করা: তিনজন লোক এক গুহায় আটকা পড়লে তারা তাদের নিজ নিজ সৎ আমল আল্লাহ্র নিকট পেশ করে প্রার্থনা করলে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করেন’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৩৮,‘সৎ আমল ও সদাচরণ’ অনুচ্ছেদ, শিষ্টাচার’ অধ্যায়)।
(৪) ওযূ করে দো’আ করা: আবু মূসা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা পানি নিয়ে ওযূ করলেন এবং হাত তুলে দো’আ করলেন (বুখারী হা/৬৩৮৩; ফাৎহুল বারী, ১১/১৮৭ পৃঃ, দো’আ সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ- ৪১)।
(৫) ক্বিবলামুখী হয়ে দো’আ করা: রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দো’আ করার ইচ্ছা করলে ক্বিবলামুখী হয়ে দো’আ করতেন’ (বুখারী হা/৬৩৪৩; ফাৎহুল বারী, ১১শ খণ্ড, পৃঃ ১৪৪, ‘দো’আ’ অধ্যায়)।
তো বন্ধুরা এই ছিলো স্ত্রী সহবাসের দোয়া ও আমলগুলি। সঠিক নিয়মে এই দোয়া ও আমলগুলি করলে আল্লাহ তাওয়ালা রাজী খুশি থাকবেন, শয়তান দূরে থাকবে, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরি হবে।
যদি লেখাটি ভালো লাগে, কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না, আজকের মতো এখানেই বিদায়, ভালো থাকবেন সবাই।