আসসালামুয়ালাইকুম সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ। আশা করি সবাই ভালো আছেন। ইসলামী শরীয়তে আমাদের জন্য অনেক বিষয়ই সহজ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তার ইবাদত থেকে শুরু করে যাবতীয় কার্যকলাপের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
কোনো কাজ শুরু করার পূর্বে বা কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা অনেক সময় বুঝি না কি করা উচিত। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য রাসুল (সা.) আমাদেরকে একটি নামাজ আদায় করার শিক্ষা দিয়েছেন। সেটি হলো ইস্তেখারা’র নামাজ। এই ইস্তেখারা নামাজের কিছু নিয়ম,ফজিলত ও দোয়া রয়েছে। আমরা আজ ইস্তেখারার নামাজের নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানবো।
ইস্তেখারার নামাজ
ইস্তেখারা একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো,কোনো কাজের ক্ষেত্রে কল্যাণ কামনা করা।
ইস্তেখারা’র নামাজ বা সালাতুল ইস্তেখারা হলো আল্লাহর নিকট কোনো কাজের ক্ষেত্রে কল্যাণ কামনা করা। কোনো কাজে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলে এই নামাজ আদায় করতে হয়।
আল্লাহ তাআলার নিকট সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইস্তেখারা করতে হয় বা সাহায্য প্রার্থনা করতে হয়,যেন তিনি তার সিদ্ধান্তকে এমন জিনিসের ওপর স্থির করে দেন যা সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর জন্য কল্যাণকর হয়।
সহজ কথায়, ইস্তেখারা হচ্ছে আল্লাহর কাছে পরামর্শ চাওয়া এবং তার ইলম ও কুদরতের মাধ্যমে তার সাহায্য কামনা করা।
ইস্তেখারা’র নামাজ একটি নফল ইবাদত। বিশেষ করে বিয়ে,ব্যবসা, বিদেশ ভ্রমন ইত্যাদি ভালো কাজের আগে ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় করা ভালো।
এছাড়া শরীয়ত বিরোধী কোনো হারাম এমনকি মাকরুহ কাজ হাসিলের ক্ষেত্রেও ইস্তেখারা করা যাবে না।ইস্তেখারা শুধু জায়েজ কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ইস্তেখারার নামাজের সময়
ইস্তেখারা নামাজের সময়ের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যেকোনো সময় ইস্তেখারা নামাজ পড়া যাবে।
নামাজের তিনটি নিষিদ্ধ সময় ব্যতীত যেকোনো সময় ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় করা যাবে। নামাজের নিষিদ্ধ তিনটি সময় হলো:
- ফজরের নামাজের পর থেকে সূর্য উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত।
- ঠিক দ্বিপ্রহরের সময়; যতোক্ষণ না সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে।
- সূর্য হলুদবর্ণ ধারণ করার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত; অর্থাৎ আসরের পর থেকে মাগরিবের পূর্ব পর্যন্ত।
উক্ত তিন সময় বাদে যেকোনো সময় ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় করা জায়েয আছে। তবে নারীদের ঋতুস্রাব চলাকালীন এই নামাজ আদায় করা যাবে না। তবে একান্ত প্রয়োজনে ওজু করে ইস্তেখারা’র নামাজের দোয়াটি পাঠ করলেই হবে।
অনেকে মনে করেন, ইস্তেখারা শুধুমাত্র রাতে কিংবা ঘুমানোর সময় করতে হয়। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা।যখনই সুযোগ হয়, তখনই ইস্তেখারা করা যাবে। রাত-দিন কিংবা ঘুম ও জাগ্রত থাকার কোনো শর্ত এখানে নেই।
ইস্তেখারার নামাজের নিয়ত:
নিম্নোক্ত নিয়ত পাঠ করে ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় করতে হয়।
বাংলা উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তাআলা রাকয়াতাই সালাতিল ইস্তেখারাতি নাফলা, মুতাওয়াজজিহান ইলা জিহাতিল কা’বাতিশ শারিফাতি ,আল্লাহু আকবার।
বাংলা অর্থ: আমি ক্বিবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়ে ইস্তেখারা’র নফল নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে নিয়ত করলাম, আল্লাহু আকবার।
আরবি নিয়ত মুখস্থ না থাকলে আরবি নিয়ত মুখে উচ্চারণ না করলেও হবে।মনে মনে নিয়ত করলেই হয়ে যাবে।
ইস্তেখারার নামাজের নিয়ম
ইস্তেখারা’র নামাজের বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। ইস্তেখারা’র নামাজ সাধারণত নফল নামাজ যেভাবে আদায় করা হয় ঠিক সেভাবে আদায় করতে হয়। যেমনভাবে যোহর, মাগরিব ও এশার নামাজের পর শেষে দুই রাকাত নফল পড়া হয় ঠিক সেই নিয়মে পড়লেই যথেষ্ট হবে। তবে ইস্তেখারার উদ্দেশ্য থাকতে হবে ।
নিচে ইস্তেখারা’র নামাজের নিয়ম উল্লেখ করা হলো-
- প্রথমে উত্তমরূপে ওজু করে পাক-পবিত্র হয়ে ক্বিবলামুখি হয়ে দাঁড়াতে হবে।
- এবার মহান আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা রেখে আস্থার উদ্দেশ্যে দুই রাকাত ইস্তেখারা’র নামাজ এর নিয়ত করতে হবে। এক্ষেত্রে আরবি নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে অথবা মনে মনে নিয়ত করতে হবে।
- এরপর “আল্লাহু আকবার” বলে নামাজ শুরু করে সানা পাঠ করতে হবে।
- এরপর সুরা ফাতিহা পাঠ করে অন্য যেকোনো সুরা পাঠ করতে হবে।
- এরপর রুকু, সেজদাহ করার মাধ্যমে প্রথম রাকআত আদায় করতে হবে।
- প্রথম রাকআতের ন্যায় দ্বিতীয় রাকআতও আদায় করতে হবে।
- দ্বিতীয় রাকআতে রুকু, সিজদাহ শেষ করার পর তাশাহুদ, দরূদ শরীফ এবং দোয়া মাসুরা পড়ে সালাম ফিরানোর পর আল্লাহ তাআলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।
ইস্তিখারা শেষে স্বপ্ন দেখতে হবে এমনটা অনেকেই মনে করেন। তবে এটি সঠিক নয়। এটি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর শেখানো একটা বিশেষ সুন্নাহ।যার মাধ্যমে আমল করলে আল্লাহ তাআলা উত্তম প্রতিদান দান করবেন। ইনশাআল্লাহ। তাই স্বপ্ন দেখা বা স্বপ্নের অপেক্ষায় না থাকাই উচিত।
ইস্তেখারার নামাজের প্রয়োজনীয় দোয়া:
ইস্তেখারা’র নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যই হলো আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা। তাই এই নামাজ আদায়ের পর একটি বিশেষ দোয়া রয়েছে যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা যায়। নামাজের পর ইস্তিখারার মাসনুন দোয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন। দোয়াটি খুব বিস্ময়কর ও তাৎপর্যপূর্ণ।
নিম্নে তা বর্ণনা করা হলোঃ-
উচ্চারণ: “আল্লাহুম্মা ইন্নী-আস্তাখিরুকা বি-ইলমিকা ওয়া আস্তাকদিরুকা বি-কুদরাতিকা ওয়াআসআলুকা মিনফাদলিকাল আযীম, ফা-ইন্নাকা তাকদিরু ওয়ালা আকদিরু, ওয়া তা’লামু ওয়ালা আ’লামু ওয়া আন্তা আল্লামুল গুয়ূব। আল্লাহুম্মা ইনকুন্তা তা’লামু আন্না “হাযাল আমরা” খাইরুল্লি ফীহ- দ্বীনী ওয়া মা’আশী ওয়া আক্বিবাতি আমরী, ফাকদুরহুলী ওয়া-্ইয়াসসিরহু লী, সুম্মা বা-রিকলী ফীহি, ওয়া ইন কুনতা তা’লামু আন্না হা’যাল আমরা শাররুল্লী ফী দীনী ওয়া মা’আশী ওয়াআকীবাতি আমরি,ফাসরিফহু আন্নী ওয়াসরীফনী আনহু ওয়াকদির লিয়াল খাইরা হাইসু কানা সুম্মা আরদিনী বিহী।”
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার জ্ঞানের সাহায্য চাইছি,তোমার শক্তির সাহায্য চাইছি এবং তোমার মহান অনুগ্রহ চাইছি। একমাত্র তুমিই শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী, আমার কোনো ক্ষমতা নেই। তুমি অফুরন্ত জ্ঞানের অধিকারী, আমার কোন জ্ঞান নেই। তুমি অদৃশ্য বিষয়ে সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত।হে আল্লাহ! তুমি যদি এ কাজটি আমার জন্য,আমার দ্বীনের দৃষ্টিকোণ হতে, আমার জীবন যাপনের ব্যাপারে এবং আমার কাজের পরিণামের দিক হতে, ভাল মনে করো তবে তা আমার জন্য নির্দিষ্ট করে দাও এবং আমার জন্য সহজ করে দাও। পক্ষান্তরে, তুমি যদি এই কাজটি আমার জন্য আমার দ্বীনের দৃষ্টিকোণ হতে,আমার জীবন যাপনের ব্যাপারে এবং আমার কাজকর্মের পরিণামের দিক হতে ক্ষতিকর মনে করো, তবে তুমি সে কাজটি আমার থেকে দূরে সরিয়ে দাও এবং আমাকে তা করা থেকে বিরত রাখ। এবং যেখান থেকে হোক তুমি আমার জন্য কল্যাণ নির্ধারণ করে দাও”
(তিরমিজি:৪৮০; ইবনু মাজাহ:১৩৮০;রিয়াদুস সলিহীন:৭২২)
**এই দোয়ার মধ্যে যেখানে যেখানে “হাযাল আমরা” শব্দটি আসবে, সেখানে মনে মনে যে কাজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছেন সেটির কথা স্মরণ করবেন।
ইস্তেখারার এই দোয়া মুখস্থ না থাকলে দেখে দেখে পড়া যাবে। তবে মুখস্থ পড়াই ভালো।
এই দোয়ার পাশাপাশি আল্লাহ তাআলার জন্য জিকির করা যায়,দরূদ শরীফও পাঠ করা যায়।
ইস্তেখারার নামাজের ফজিলত:
ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সা.) অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
হাদীসে এসেছে, হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, “হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যেভাবে কুরআনের সূরা শেখাতেন ঠিক সেভাবেই প্রতিটি কাজের আগে আমাদের ইস্তেখারা করার শিক্ষা দিতেন।”
অপর এক হাদিসে এসেছে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বনি আদমের সৌভাগ্য হলো,আল্লাহর কাছে ইস্তেখারা করা।
বনি আদমের আরো সৌভাগ্য হলো, আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। আর বনি আদমের দুর্ভাগ্য হলো, আল্লাহর নিকট ইস্তেখারা করা বন্ধ করে দেওয়া। বনি আদমের আরও দুর্ভাগ্য হলো, আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তার উপর অসন্তুষ্ট হওয়া।’ (মুস্তাদরাক হাকেম: ১৯০৩)।
কোনো কিছু নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা থাকলে এই নামাজ পড়লে অনেক নিয়ামত পাওয়া যায়।
কারন এই ইস্তেখারা’র নামাজের মাধ্যমে আমাদের সকল সিদ্ধান্তের কথা মহান আল্লাহ্র কাছে জানিয়ে এবং সকল সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য দোয়া করা যায়।
ইস্তেখারা’র নামাজের ফলে আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ভালো ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেন এবং খারাপ কোনো কাজ করা থেকে বিরত রাখেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এটা তো খুবই সম্ভব যে, তোমরা একটা জিনিস মন্দ মনে করো,অথচ তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর এটাও সম্ভব যে, তোমরা একটা জিনিস কে পছন্দ করো, অথচ তা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আর প্রকৃত বিষয়ে তো আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জানো না।’ (সূরা বাকারা: ২১৬)
তাই আমাদের উচিত, কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসলে ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় করে নেওয়া।
কোনো কাজ করতে গিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেলে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ইস্তেখারার কোনো বিকল্প নেই।আর এটিই ইসলামের নির্দেশ।
ইস্তেখারা’র নামাজ ব্যক্তিগত বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা থেকে মুক্তি দেয়। এর মাধ্যমে আল্লাহর উপর ঈমান ও তাওয়াক্কুল বৃদ্ধি পায়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সাথে বান্দার একটা গোপন, অথচ সরাসরি যোগসুত্র তৈরি হয়। যা প্রতিটি বান্দার দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হওয়ার নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
একটি কাজের ক্ষেত্রে একাধিকবার ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় করা যায়। একদা হযরত আনাস (রা.) কে রাসুল (সা) সাতবার ইস্তেখারা করতে বলেছিলেন।
অনেকে মনে করেন ইস্তেখারা’র নামাজ আদায়ের পর কারো পরামর্শ গ্রহণ করা যাবে না। এটি একটি ভুল ধারণা।এ সম্পর্কে শায়খ ইবনে উসাইমীন (রহ.) বলেছেন, “তিনবার ইস্তেখারা করার পরেও যদি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া না যায়, তাহলে পরামর্শ নেওয়া যাবে।”
আল্লাহ তাআলা বলেছেন,‘এবং তাদের সাথে পরামর্শ করতে থাকুন। অতঃপর যখন আপনি কোনো বিষয়ে মনস্থির করবেন, তখন আল্লাহর উপর নির্ভর করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান: ১৫৯)
মানুষ ইস্তেখারা’র মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়, যাতে সফলতার দিকনির্দেশনা পায়।
মহান আল্লাহ বলেছেন,: “তোমরা স্বীয় প্রতিপালককে ডাক, কাকুতি-মিনতি করে ও সংগোপনে।”
(সূরা আরাফ : ৫৫)
এক জনের পক্ষ থেকে আরেকজন ইস্তেখারা’র নামাজ আদায় করতে পারবে না। তবে সাধারণভাবে তার কল্যাণের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতে পারে।
ইস্তেখারা’র নামাজ শরিয়ত স্বীকৃত একটি ইবাদত। তাই এর গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক।
মহান আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিকভাবে সুন্নতের অনুসরণে এসব ইবাদত পালন করার তৌফিক দান করুক। আমীন।
Tag: ইস্তেখারার দোয়া, ইস্তেখারা নামাজের নিয়ত, ইস্তেখারার নামাজ এর নিয়ত, istikhara namaz bangla