আসসালামু আলাইকুম সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ। আশা করি সবাই ভালো আছেন। নামাজ মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কারণ আল কোরআনে নামাজকে জান্নাতের চাবি বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পাই। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সালাতুল বিতর বা বিতর এর নামাজ। আজ আমরা এই বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
বিতর নামাজ:
বিতর (وتر) একটি আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো বিজোড়। বিতর নামাজ তিন রাকআত হওয়ার কারণে একে “সালাতুল বিতর” নামে নামকরণ করা হয়েছে।
বিতর নামাজ এশার নামাজের পর আদায় করতে হয়।বিতর নামাজ আদায় করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।
এশার নামাজ আদায়ের পরপরই বিতর নামাজ আদায়ের সময় শুরু হয়। আর এর ওয়াক্ত শেষ হয় সুবহে সাদিকের উদয়ের মাধ্যমে। অর্থাৎ ফজরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হলে বিতর নামাজের ওয়াক্ত আর থাকে না।
স্বাভাবিক নিয়মে বিতর শেষ রাতে পড়াই উত্তম আর যদি কেউ শেষ রাতে জাগ্রত হওয়ার ব্যাপারে আস্থাশীল থাকেন। কেননা নবী (স.) বলেছেন, বিতর কে তোমাদের রাতের শেষ সালাত করবে। (সহিহ বুখারি:৯৯৮)
আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেন, “তোমরা তোমাদের রাতের নামাজের সর্বশেষে বিতর নামাজ আদায় করবে।” (বুখারী -৯৪৩, মুসলিম -১২৪৫)
এর কারণ হলো, শেষ রাতের নামাজের সময় ব্যাপক হারে ফেরেশতারা উপস্থিত থাকেন এবং এটাই উত্তম।
রমজান মাসের ক্ষেত্রে, তারাবিহ নামাজের পর বিতর নামাজ আদায় করা যাবে অথবা কেউ গভীর রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে চাইলে তারপর বিতর নামাজ আদায় করবে।
তবে রমজান মাসে বিতর নামাজ একাকি আদায় করার চেয়ে জামাআতের সহিত ইমামের সাথে আদায় করা উত্তম।
বিতর নামাজ কত রাকাত?
বিতর নামাজের মধ্যে বৈচিত্র্য আছে। ১ থেকে ১১ রাকআত পর্যন্ত বিতর নামাজ আদায় করা যায়।১,৩,৫,৭,৯ ও ১১ এভাবে বিজোড় সংখ্যা অনুযায়ী বিতর নামাজ আদায় করতে হয়। তবে বেশিরভাগ ওলামায়ে কেরাম তিন রাকআত বিতর নামাজের ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছেন।তাই তিন রাকআত পড়াই উত্তম।
অনেকে মনে করেন, এক রাকআত বিতর নামাজ পড়া যায় না,এ ধারণা একদম ভুল। এক রাকআত বিতর পড়লেও কোনো ক্ষতি নেই। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে, ‘যে এক রাকআত বিতর সালাত পড়তে চায় সে এক রাকআত পড়তে পারে।’ – (আবু দাউদ)
এক রাকআত বিতর নামাজ পড়া সম্পর্কে হাদীসে আরো এসেছে, আবদুল্লাহ বিন উমার (রাযি.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিতর হলো এক রাকআত রাতের শেষাংশে।”
এছাড়া সাহাবীগণের আমলেও এক রাকআত দ্বারা বিতর নামাজ পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।
এছাড়াও আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগারো রাকআত সালাত আদায় করতেন। এটি ছিল তার রাত্রিকালীন সালাত। এতে তিনি এমন দীর্ঘ সিজদাহ করতেন যে, তার মাথা উঠাবার আগে তোমাদের কেউ ৫০ আয়াত পড়তে পারে এবং ফজরের সালাতের আগে তিনি আরো দুই রাকআত আদায় করতেন। তারপর ডান কাত হয়ে শুয়ে বিশ্রাম করতেন সালাতের জন্য মুয়াজ্জীনের আসা পর্যন্ত।” (সহীহ বুখারী)
৩ রাকাত বিতর নামাজ পড়ার নিয়ত:
নিয়ত শব্দের অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা বা সংকল্প।এই ইচ্ছা বা সংকল্প অন্তর থেকে করতে হয়।কোন ইচ্ছা বা সংকল্প মুখে উচ্চারণ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আসল নিয়ত হলো মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করা।
বিতর নামাজের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ত নেই। তাই এসময় মুখে আরবিতে উচ্চারণ করে নিয়ত করারও প্রয়োজন নেই।
শুধু মনে মনে সংকল্প করতে হবে যে, “আমি বিতর নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে ক্বিবলামুখি হয়ে দাঁড়িয়েছি।”
বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম:
বিতর নামাজ অন্যান্য ফরজ নামাজের ন্যায় আদায় করতে হয়। তবে নিয়মের ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। এশার নামাজের পর মনে মনে বিতর নামাজের নিয়ত করতে হবে। এরপর নিম্নোক্ত নিয়মে এক অথবা তিন রাকআত বিতর নামাজ আদায় করতে হবে।
এক রাকআত বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম:
নামাজের শুরুতে সাধারণ নামাজের মতই সানা ও সুরা ফাতেহা পাঠ করতে হবে সাথে অন্য একটি সুরা বা আয়াত কেরাত হিসেবে পাঠ করতে হবে।তার পর রুকুতে যেতে হবে। রুকু থেকে উঠে সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ্..রব্বানা লাকাল হামদ পাঠ করে মুনাজাতের মত দুই হাত তুলে ”দুয়া কুনুত” পাঠ করতে হবে।এরপর দরূদ শরীফ ও অন্যান্য আরবি দুয়া পাঠ করা যাবে। এর পর দুটি সিজদাহ করে শেষ বৈঠকে তাশাহুদ,দরূদ শরীফ ও দোয়া মাসুরার মাধ্যমে নামাজ শেষ করতে হবে।
তিন রাকআত বিতর নামাজ পড়ার নিয়ম:
এক্ষেত্রে সাধারণ নামাজের মতো দুই রাকআত আদায় করার পর সরাসরি তৃতীয় রাকআত পড়ার জন্য উঠে সুরা ফাতিহার সঙ্গে অন্য কোনো সুরা বা আয়াত মিলিয়ে পড়ার পর রুকুতে যেতে হবে।
রুকু থেকে উঠে সামিয়াল্লাহু লিমান হামিদাহ্..রব্বানা লাকাল হামদ পাঠ করে হাত তুলে দোয়া কুনুত ,দরূদ শরীফ ও অন্যান্য দোয়া পাঠ করে সিজদাহ ও শেষ বৈঠকের মাধ্যমে নামাজ শেষ করতে হবে।
এক্ষেত্রে দুই রাকআত এর পর না বসার কারণ হলো এর সাথে মাগরিবের নামাজের পার্থক্য সৃষ্টি করা। কারণ রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বিতরের সালাতকে মাগরিবের সালাতের মতো করে দিও না’
সাদ ইবনে হিশাম (রহ.) বলেন, আয়েশা (রা.) তাকে বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বিতর এর দুই রাকাতে সালাম ফেরাতেন না। (সুনানে নাসায়ি ১/২৪৮, হাদিস ১৬৯৮,মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ৪/৪৯৪, হাদিস ৬৯১২)।
এর মাধ্যমে বোঝা যায়,বিতরের তৃতীয় রাকআতে একবারই সালাম ফিরাতে হয়।
বিতর নামাজের উপরোক্ত নিয়ম অনুযায়ী মক্কা ও মদিনায় বিতর নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে।
বিতর নামাজের প্রয়োজনীয় দোয়া:
বিতর নামাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোয়া হলো দোয়া কুনুত।
দোয়া কুনুত এর বাংলা উচ্চারণ:
আল্লাহুম্মা ইন্না নাস্তাঈ’নুকা,ওয়া নাস্তাগ্ফিরুকা,ওয়া নু’মিনুবিকা, ওয়া নাতাওয়াক্কালু ‘আলাইকা,ওয়া নুছনী আলাইকাল খাইর। ওয়া নাশকুরুকা, ওয়ালা নাকফুরুকা, ওয়া নাখলাউ ওয়া নাতরুকু মাই ইয়াফজুরুকা। আল্লাহুম্মা ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া লাকানুসল্লি, ওয়া নাসজুদু,ওয়া ইলাইকা নাস’আ,ওয়া নাহফিদু,ওয়া নারজু রাহমাতাকা, ওয়া নাখশা..আযাবাকা,ইন্না আযাবাকা বিল কুফ্ফারি মুলহিক্ব।
বাংলা অর্থ:
হে আল্লাহ! আমরা তোমারই সাহায্য চাই। তোমার নিকটই ক্ষমা চাই,তোমারই প্রতি ঈমান রাখি, তোমারই ওপর ভরসা করি এবং সকল মঙ্গল তোমারই দিকে ন্যস্ত করি। আমরা তোমার কৃতজ্ঞ হয়ে চলি,কখনো অকৃতজ্ঞ হই না। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব করি, তোমারই জন্য সালাত আদায় পড়ি এবং তোমাকেই সিজদাহ করি। আমরা তোমারই দিকে এগিয়ে চলি। আমরা তোমারই রহমত আশা করি এবং তোমার আযাবকে ভয় করি।আর তোমার আযাব তো কাফেরদের জন্যই র্নিধারিত।
অনেকের দোয়া কুনুত মুখস্থ না -ও থাকতে পারে সেক্ষেত্রে দুরূদ শরীফ ও অন্যান্য দোয়া পাঠ করে ও বিতর নামাজ আদায় করা যায়।কারণ বিতর নামাজে দোয়া কুনুত পড়া ফরজ নয় বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদা।
অনেকে দোয়া কুনুত এর বদলে তিনবার সুরা ইখলাস পড়ার কথা বলেন।
কিন্তু বিতর নামাজে দোয়া কুনুতের পরিবর্তে তিনবার সুরা ইখলাস পড়া গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, সুরা ইখলাস কুনুত বা দোয়া সম্বলিত সুরা নয়।
দোয়া কুনুত মুখস্থ না থাকলে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করা যায়।
“রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতে হাসানাতাও ওয়া কিনা আজাবান নার”
অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক,আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ এবং আখিরাতে কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।
(সুরা বাকারা:২০১)
এছাড়াও বিতর নামাজের পর কিছু দোয়া ও তাসবিহ পাঠ করা যায়।
হজরত উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিতর এর নামাজের সালাম ফেরানোর পর (৩ বার) এই দোয়া পড়তেন- سُبْحَانَ المَلِكِ الْقُدُّوْس
উচ্চারণ : ‘সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুস’
বাংলা অর্থ : ‘পূত পবিত্র রাজাধিরাজ আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ঘোষণা করছি’ (মিশকাত:১২৭৪)
এরপর তিনি টেনে টেনে পড়তেন –
“রাব্বিল মালা-ইকাতি ওয়ার-রূহ”
অর্থ: “যিনি ফেরেশতা ও রূহ -এর রব”
বিতর নামাজের ফজিলত:
রাতের আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিতরের নামাজ।বিতর নামাজ আদায় করা ফরজের মতো আবশ্যক না হলেও বিতর নামাজ ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। সহীহ হাদিসের বর্ণনা থেকেই তা প্রমাণিত হয়েছে।তাই বিতর নামাজের অনেক ফজিলত রয়েছে। কুরআন ও হাদীসে এর গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে–
- রাসুল (সাঃ) কখনো বিতর ছাড়তেন না এবং সাহাবিদেরও বিতর নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিতেন।
- অন্য এক হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেন, ‘হে কোরআনের অনুসারীরা,তোমরা বিতর পড়। কারণ,আল্লাহ তাআলা বিতর (বিজোড়) এবং তিনি বিতর পছন্দ করেন।’ (তিরমিযি:৪৫৩ ,আবু দাউদ:১৪১৬,মুসনাদে আহমাদ)
- হজরত আলি (রা.) বর্ণনা করেছেন,বিতরের নামাজ তোমাদের ফরজ নামাজ সমূহের মতো অত্যাবশ্যকীয় (ফরজ) নামাজ নয় বরং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই নামাজ তোমাদের জন্য সুন্নাত রূপে প্রবর্তন করেছেন।
- বিতরের নামাজ এর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ (সা.) বিশেষ তাগিদ দিয়ে বলেন,”বিতরের নামাজ পড়া আবশ্যক। যে ব্যক্তি বিতর আদায় করবে না, আমাদের জামাআতের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।”(আবু দাউদ)
- খারেজা ইবনে হুযাফা (রাঃ) বলেন,রাসূলুল্লাহ (সা.) একদা আমাদের নিকট এসে বললেন–”নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তােমাদেরকে একটি নামাজ দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন যেটা তোমাদের জন্য লাল উটের চেয়ে উত্তম। তা হচ্ছে ‘বিতর নামাজ’। এ নামাজ আদায় করার জন্য তিনি সময় নির্ধারণ করেছেন যা এশার নামাজের পর থেকে ফজর উদিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।”( (আবু দাউদ, তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মুসতাদরাকে হাকেম)
- রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বিতর নামাজ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। এমনকি সফরে গেলেও এ নামাজ পড়া ছাড়তেন না।
- আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,”নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ঘুমানোর আগে বিতর আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।”
- ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে ফরজ সালাত ব্যতীত তার বাহনে থেকেই ইশারায় রাতের সালাত আদায় করতেন। বাহন যে দিকেই ফিরুক না কেন,তিনি বাহনের উপরেই বিতর সালাত আদায় করতেন।”(সহীহ বুখারী)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, বিতর নামাজ আমাদের মুসলিম উম্মাহর জন্য কতটা উপকারী ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি ইবাদত। তাই বিতর নামাজ (ফরজ-ওয়াজিব-সুন্নাতে মুয়াক্কাদা) কি-না এসব নিয়ে কোনো বিতর্ক করা উচিৎ নয়। বরং প্রিয় নবির আমল হিসেবে আমাদের সবারই বিতর নামাজ পড়া উচিত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিকভাবে সুন্নতের অনুসরণে এসকল ইবাদত পালন করার তৌফিক দান করুক। আমিন।