আসসালামুয়ালাইকুম সুপ্রিয় পাঠক বৃন্দ। আশা করি সবাই আল্লাহর রহমতে ভালো ও সুস্থ আছেন। আমরা সবাই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছু আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দান করেন।
তিনি আমাদেরকে সকল প্রকার বিপদ আপদ ও রোগ বালাই থেকে রক্ষা করেন। তাই বিপদে পড়লে বা কোনো ধরনের ইচ্ছা পোষণ করতে অবশ্যই আল্লাহ তায়ালার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। আর এজন্য একটি বিশেষ নামাজ রয়েছে যার নাম ‘সালাতুল হাজত’।
এই নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নিকট নিজের ইচ্ছা ও প্রয়োজনের কথা জানিয়ে দোয়া করা যায়।
এটি অনেক ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত।
আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে নামাজের মাধ্যমে দোয়া ও সাহায্য কামনা করার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাই প্রত্যেক মুমিন ভাই-বোনদের উচিত এই নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে সেই অনুযায়ী আমল করা। এতে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ নিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ। তো চলুন জেনে নেই সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম, নিয়ত ও দোয়া সম্পর্কে।
সালাতুল হাজত নামাজ
সালাতুল হাজত নামাজ একটি নফল ইবাদত। মূলত ‘হাজত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা বা প্রয়োজন। অর্থাৎ ‘সালাতুল হাজত’ হচ্ছে ইচ্ছা বা প্রয়োজন পূরণের নামাজ। শরীয়তের পরিভাষায়, যেকোনো বৈধ প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে নফল নামাজ আদায় করাকে সালাতুল হাজত বলে।
সালাতুল হাজতের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নিকট তার প্রয়োজন ও ইচ্ছা নির্দিধায় প্রকাশ করতে পারে।
এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
“হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও সালাত আদায়ের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।”
(সূরা বাকারা: ১৫৩)
একইভাবে আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তার উম্মতকে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার শিক্ষা দিয়েছেন।
তাই একজন মুমিনের উচিত ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক বা যেকোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে সালাতুল হাজত আদায় করার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা।
সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম
যেহেতু সালাতুল হাজত একটি নফল নামাজ তাই সালাতুল হাজত নামাজ আদায়ের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। এটি অন্যান্য নফল নামাজের ন্যায় দুই রাকাত আদায় করতে হয়।
স্বাভাবিকভাবে উত্তমরূপে অজু করে নিয়ত পড়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করতে হয়। নামাজের মধ্যে অন্যান্য নামাজের ন্যায় সূরা ফাতেহার সাথে অন্যান্য সূরা মিলিয়ে পড়া যাবে।
নামাজ আদায় শেষে আল্লাহ তায়ালার হামদ ও ছানা (প্রশংসা) এবং নবী করিম (সা.) এর ওপর দরূদ শরিফ পাঠ করে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করে আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করতে হয়।
কোনো বিপদে পড়লে সেটার জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। হালাল কোনো কিছু চাওয়ার জন্যও সালাতুল হাজত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সেটার জন্য প্রার্থনা করতে হবে।
সালাতুল হাজতের নিয়ত
সালাতুল হাজত একটি নফল ইবাদত। নফল নামাজের জন্য যেমন নিয়ত পড়তে হয় তেমনি সালাতুল হাজতের জন্যও নিয়ত পড়ে নিতে হয়। আরবিতে সালাতুল হাজতের নিয়ত রয়েছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হলোঃ
“নাওয়াইতুয়ান উসাল্লি লিল্লাহি তা’আলা রাক’আতাই সালাতুল হাজত সালাতি নাফলি রাসূলিল্লাহি তা’আলা মুতাওয়াজজিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবর।”
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ, আমি কাবা ঘরের দিকে মুখ করে আপনার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সালাতুল হাজতের দুই রাকাত নফল নামাজ আদায়ের জন্য নিয়ত করছি, আল্লাহু আকবর।
উক্ত আরবি নিয়ত কারো মুখস্থ না থাকলে মুখে বাংলায় নিয়ত করে সালাতুল হাজত আদায় করতে পারবেন।
সালাতুল হাজত নামাজ আদায়ের সময়
সালাতুল হাজত নামাজ আদায়ের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কোনো বিপদ আপদ ও কোনো প্রয়োজনীয়তার জন্য সালাতুল হাজত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতেন। তাই নামাজের নিষিদ্ধ সময় (সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত এবং দ্বিপ্রহর) বাদে যেকোনো সময় এটি আদায় করা যাবে।
তবে সালাতুল হাজতের জন্য উপযুক্ত সময় হলো এশার নামাজ আদায়ের পর বা ঘুমানোর আগে অথবা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের সময়ে। এছাড়াও যেকোনো ওয়াক্তের নামাজের পর সালাতুল হাজত পড়া যায়।
সালাতুল হাজতের দোয়া সমূহ
সালাতুল হাজত আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনার জন্য আদায় করা হয়। সালাতুল হাজত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট দোয়া করা হয়। তাই বেশ কিছু দোয়া রয়েছে যা সালাতুল হাজতের পর পাঠ করা উত্তম।
দোয়াগুলো পাঠ করার পর আল্লাহর কাছে নিজ ভাষায় বৈধ প্রয়োজনের জন্য প্রার্থনা করতে হয়। দোয়ার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে হাদিস শরিফে নিন্মোক্ত দোয়া সমূহ পাঠের বর্ণনা রয়েছে।
নিম্নে সালাতুল হাজতের দোয়াগুলো উল্লেখ করা হলোঃ
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল হালিমুল কারিম, সুবহানাল্লাহি রব্বিল আরশিল আজিম, আলহামদুলিল্লাহি রব্বিল আলামিন, আসআলুকা মুজিবাতি রাহমাতিক , ওয়া আযায়িমা মাগফিরাতিক, ওয়াল গানিমাতা মিন কুল্লি বিররি ওয়াস-সালামাতা মিন কুল্লি ইসমিন লা তাদা’লি-জাম্বান ইল্লা গাফারতাহু ওয়ালা হাম্মান ইল্লা ফাররাজতাহু ওয়ালা হা-জাতান হিয়া লাকা রিদান- ইল্লা কাদ্বাইতাহা ইয়া আরহামার রা-হিমিন।”
(তিরমিজি-৪৭৯; ইবনু মাজাহ-১৩৮৪)
বাংলা অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই। তিনি অতি সহিষ্ণু ও দয়ালু, সকল দোষ-ক্রটি থেকে তিনি পবিত্র। তিনি এই মহান আরশের প্রভু। সকল প্রশংসা সারা জাহানের রব আল্লাহ তায়ালার। আপনার কাছে আমি আপনার রহমত লাভের উপায়সমূহ, আপনার ক্ষমা লাভের কঠিন ওয়াদা, প্রত্যেক ভালো কাজের ঐশ্বর্য এবং সকল মন্দ কাজ হতে নিরাপত্তা চাইছি। আপনি আমার প্রতিটি অপরাধ ক্ষমা করুন এবং আমার দুশ্চিন্তা দূর করুন। আমার সমস্যার সমাধান করুন আর আমার এমন প্রয়োজন— যাতে আপনার সন্তুষ্টি রয়েছে, তা পরিপূর্ণ করে দিন। হে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।
এছাড়াও সালাতুল হাজতের শেষে নিম্নের দোয়াটি পাঠ করা যায়ঃ
“আল্লাহুম্মা রব্বানা আ-তিনা ফিদ্দুন্ইয়া হাসানাতাঁও ওয়া ফিল আ-খিরাতি হাসানাতাঁও ওয়া ক্বিনা আযা-বান্না-র।”
বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! আপনি আমাদের দুনিয়াতে মঙ্গল দিন এবং আখেরাতেও মঙ্গল দিন। এবং জাহান্নামের আজাব হতে আমাদের রক্ষা করুন।
হযরত আনাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) অধিকাংশ সময় এ দোয়াটি পড়তেন।’
(বুখারি- ৪৫২২,৬৩৮৯; মিশকাত- ২৪৮৭; মুসলিম, মিশকাত- ৮১৩)
উক্ত দোয়া গুলো সালাতুল হাজতের পাশাপাশি অন্যান্য নামাজের পরও পাঠ করা যাবে।
এছাড়া সালাতুল হাজতে সিজদারত অবস্থায় নিজের প্রয়োজনের জন্য দোয়া করা উত্তম। কেননা, এটি দুআ কবুলের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়।
এ সম্পর্কে ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,
“তোমরা শুনে রেখো ! আমাকে নিষেধ করা হয়েছে রুকু অবস্থায় কিরাত থেকে এবং সিজদা অবস্থায়। রুকুতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা করো আর সিজদায় তোমরা বেশি করে দোয়া করো। তোমাদের জন্য দোয়া কবুল হওয়ার উপযুক্ত সময় এটাই।”
(সুনান নাসাঈ হ/১১২০)
তাই সালাতুল হাজতের সিজদারত অবস্থায় এবং নামাজ আদায়ের পর আল্লাহর নিকট দোয়া প্রার্থনা করতে হয়।
সালাতুল হাজত নামাজের ফজিলত
অন্যান্য নফল নামাজের মতো সালাতুল হাজতও অনেক ফজিলতপূর্ণ একটি ইবাদত। আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো বিপদে পতিত হলে বা যেকোনো প্রয়োজনে সালাতুল হাজত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতেন। এ নামাজ আদায়ের জন্য তিনি তার সাহাবাদেরকেও উৎসাহ দিতেন।
হাদীস শরীফেও এই সালাত আদায়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা করা হয়েছেঃ
হজরত হুজাইফা (রা.) হতে বর্ণিত,
“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রয়োজন বা বিষয় (বিপদ-আপদ) চলে আসতো; তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।”
(আবু দাউদ:১৩২১)
অন্য একটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন,
“যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ অজু করে সুন্দরভাবে দুই রাকআত নামাজ পড়বে, সে আল্লাহর কাছে যা চাইবে তা তিনি দান করবেন।”
(মুসনাদে আহমদ)
এই হাদীসে দুই রাকআত নামাজ বলতে সালাতুল হাজতকেই বোঝানো হয়েছে। আর ভালোভাবে অজু করে সাধারণ নিয়মে দুই রাকাত নামাজ আদায় করাই হলো সালাতুল হাজতের সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি।
সালাতুল হাজতে নবী করীম (সা.) এর ওপর দরূদ পাঠ করা হয় আর নবী করীম (সা.) এর ওপর দরূদ পাঠের বরকত ও ফজিলতে মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষের যেকোনো বিপদ দূর করে দেন। কাজেই বৈধ পন্থায় বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পেতে সালাতুল হাজতের ভূমিকা অপরিসীম।
পরিশেষে বলা যায়
আমাদের প্রয়োজন কেবল আল্লাহ তায়ালাই পূরণ করতে পারেন। তিনিই আমাদের পালনকর্তা ও রক্ষাকারী। তাই জীবনে চলার পথে যেকোনো প্রয়োজনে বা বিপদে পড়লে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার নিকটই সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। আর এজন্য সালাতুল হাজতের ফজিলত অনেক।
আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মুমিন বান্দাদের সালাতুল হাজত আদায়ের মাধ্যমে তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করার তৌফিক দান করুন, আমীন।
তো বন্ধুরা এই ছিলো আমাদের আজকের লেখা সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম, এর ফযীলত ও দোয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা। যদি এই লেখা সম্পর্কে কোন ধরনের প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।
সচরাচর জিজ্ঞাসা
সালাতুল হাজত কি দলগতভাবে আদায় করা যাবে?
সালাতুল হাজত একাকি এবং দলগত উভয়ভাবেই আদায় করা যাবে। এ বিষয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
সালাতুল হাজত কি দিনে একাধিকবার আদায় করা যায়?
হ্যাঁ, দিনে যতবার ইচ্ছা ততবার সালাতুল হাজত বা প্রয়োজন পূরণের নামাজ আদায় করা যাবে।
সালাতুল হাজতের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম আছে কি?
সালাতুল হাজতের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই। এটি দুই রাকাত নফল নামাজ, যা স্বাভাবিক নফল নামাজের নিয়মে আদায় করতে হয়।