আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন আমাদের মা। সন্তান গর্ভে ধারণ করা একজন নারীর জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। এজন্য ইসলাম ধর্মে প্রত্যেক মায়ের জন্য রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এ কারণেই বলা হয়েছে,
‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত’।
নবী করীম হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তান গর্ভে ধারণ করাকে ইবাদত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, গর্ভবতী নারী ওই ব্যক্তির মতো যে সারাদিন রোজা রাখে এবং রাত জেগে ইবাদত করে। সুবহানাল্লাহ।
গর্ভে সন্তান আসা একজন নারীর জন্য সম্মান ও সৌভাগ্যের বিষয়। একজন গর্ভবতী মায়ের পূর্ণ মনোযোগ থাকে তার অনাগত সন্তানকে কেন্দ্র করে।
তাই এ সময়ে তার উচিত আল্লাহর নিকট তার সন্তানের কল্যানের জন্য দোয়া করা, তার সুস্থতা কামনা করা। এমন কিছু আমল রয়েছে যা গর্ভবতী মা ও তার সন্তানের জন্য কল্যানকর ফলাফল বয়ে আনে।
সেসব আমল সম্পর্কে সব মায়েরই জানা উচিত এবং সেগুলো বেশি বেশি চর্চা করা উচিত। এমনই কিছু গর্ভবতী মায়ের আমল সম্পর্কে আজকের এই আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
গর্ভবতী মায়ের আমল:
মায়ের গর্ভে সন্তান ভ্রুণ থাকা অবস্থা থেকেই মায়ের যাবতীয় চাল-চলন ও গতিবিধির একটা বিরাট প্রভাব তার সন্তানের ওপর পড়ে থাকে। এজন্য এ সময়ে মায়ের উচিত বেশি বেশি নেক আমল করার চেষ্টা করা।
এ সময়ের ইবাদত অন্য সময়ের ইবাদতের চেয়ে অনেক দামি ও মূল্যবান। গর্ভবতী মায়ের জন্য আল কুরআন ও হাদীসে আলাদা করে কোনো আমল করার কথা বলা হয় নি।
তবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক আমল করা যায়। যার মাধ্যমে তার সন্তান জন্মের আগে থেকেই আল্লাহর নিকট থেকে রহমত লাভ করতে পারে। চলুন জেনে নেই তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল সম্পর্কে।
নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়াঃ
গর্ভাবস্থায় মনে অনাগত সন্তানকে নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা থাকে, ভয় থাকে। তাই এ অবস্থায় সময়মতো নামাজ আদায় করলে মনে প্রশান্তি আসে। আর দাড়িয়ে নামাজ পড়তে কষ্ট হলে বসে বসে নামাজ আদায় করতে পারবে।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি সম্ভব হলে নফল নামাজ এবং তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা উত্তম।
আল্লাহর জিকির করাঃ
গর্ভবতী মায়েদের দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করতে আরেকটি কার্যকর পন্থা হলো আল্লাহর জিকির করা। অবসরে ছোট ছোট জিকিরে সময় ব্যয় করতে পারলে হতাশা ও দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত থাকা যায়। আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে আত্মায় প্রশান্তি আসে এবং অনেক নেকি লাভ করা যায়।
আল্লাহর পবিত্র নামে তার জিকির করা আল্লাহর নিকট অনেক পছন্দনীয়। তাই গর্ভাবস্থায় বেশি বেশি আল্লাহর জিকির করতে হবে।
কুরআন তিলাওয়াত করাঃ
গর্ভাবস্থার ২০ তম সপ্তাহের পর গর্ভের সন্তান কোনোকিছু শোনার সক্ষমতা রাখে। এজন্য গর্ভবতী মা যদি নিয়মিত আল কুরআন তিলাওয়াত করে তবে গর্ভে থাকা অবস্থায়ই তার সন্তানের সাথে আল কুরআনের একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়ে যাবে।
ফলে সেই সন্তান একজন নেক সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে আগমন করবে।
আল্লাহর নিকট দোয়া করাঃ
গর্ভাবস্থায় নিজের অনাগত সন্তানের জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে। তার কল্যাণ এবং উত্তম ভবিষ্যতের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে। কারণ আল্লাহ তায়ালা এ সময়ের দোয়া কবুল করেন। একাকী আল্লাহর সাথে নিজের ভয় ও কষ্টের কথা বললে আল্লাহ তায়ালার সাথে বন্ধন সৃষ্টি হবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে অধিক মর্যাদাপূর্ণ বিষয় আর নেই।’
(তিরমিজি)
সুন্নাহ সম্মত আমল করাঃ
গর্ভাবস্থায় নিজের এবং অনাগত সন্তানের জন্য আল্লাহর নিকট শয়তানের কাছ থেকে পানাহ চাইতে হবে। এজন্য বেশি বেশি দুআ এবং নেক আমল করতে হবে। আল্লাহর নিকট দোয়া করতে হবে যেন তিনি সন্তানকে শয়তানের কাছ থেকে হেফাজত করেন।
গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকাঃ
গর্ভাবস্থায় নেক সন্তান লাভের জন্য নিজে সমস্ত পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সময় যেহেতু মায়ের রক্ত গ্রহণ করে তার গর্ভের সন্তান বড় হয়। সুতরাং এই রক্তে পাপের ক্রিয়া সংমিশ্রিত থাকলে সন্তানের মাঝেও পাপী মানসিকতার বিস্তার ঘটাতে পারে।
পক্ষান্তরে এ সময় নেককাজ করলে তার ভালো প্রভাবও সন্তানের ওপর পড়ে। তাই এ সময়ে পাপ কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে, হারাম খাদ্য খাওয়া যাবে না এবং এমন কোনো কাজ করা যাবে না যা অনাগত সন্তানের জন্য কল্যানকর নয়।
রিলেটেডঃ নরমাল ডেলিভারি হওয়ার উপায়, লক্ষণ ও উপকারিতা
আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করাঃ
মাতৃত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় নেয়ামত। যিনি গর্ভে সন্তান লাভ করেন তিনি পরম সৌভাগ্যবতী। কারণ অনেকের ভাগ্যে সন্তান লাভের এই নেয়ামত থাকে না। এজন্য একজন গর্ভবতী মায়ের উচিত এজন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’
(সুরা বাকারা : ১৫২)
সবসময় পাক-পবিত্র থাকাঃ
দৈহিক সুস্থতা এবং আত্মার শান্তির জন্য সবসময় পাক-পবিত্র থাকা জরুরি। আর গর্ভবতী মায়ের জন্য সবসময় ওজু করে থাকা উত্তম। ঘুমানোর আগে ওজু করে ঘুমালে অনিদ্রাজনিত সমস্যা দূর হয়। এতে শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তিও লাভ হবে। পাক-পবিত্র থাকলে শয়তানের ধোঁকা থেকেও বাঁচা যায়।
গর্ভের সন্তান সুস্থ থাকার আমল:
গর্ভাবস্থায় নিজের এবং নিজের সন্তানের সুস্থতার জন্য বেশি বেশি আমল করা প্রয়োজন। কুরআন ও হাদীসে এ ধরনের কিছু আমল সম্পর্কে বলা হয়েছে। নিম্নে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো–
- প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর পূর্বে এবং ফজরের নামাজের পর ১১ বার সূরা ইখলাস পাঠ করা। এতে গর্ভের সন্তান সুস্থ থাকবে।
- প্রতিদিন সকালে উঠে দরূদ শরীফ পাঠ করা।
- গর্ভের সন্তানের কল্যানের জন্য মাঝে মাঝে নফল রোজা রাখা।
- প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর জিকির করা এবং নবী করীম (সা.) এর প্রতি দরূদ শরীফ পাঠ করা।
- সম্ভব হলে প্রতিদিন সূরা ইয়াসিন পাঠ করা।
- রাতে ঘুমানোর আগে ওজু করে আয়াতুল কুরসি পাঠ করা। এতে সন্তান জাদু-টোনা ও কুনজর থেকে রক্ষা পাবে।
- নিরাপদ সন্তান জন্মদান এবং সুস্থ ও সুন্দর সুসন্তান কামনায় বারবার আল্লাহর নিকট দোয়া করা।
- প্রতিদিন কুরআন তিলাওয়াত, হাদিস পাঠ করা এবং ইসলামের মনীষীদের জীবনী পড়া।
এই ছোট ছোট আমল করার মাধ্যমে গর্ভবতী নারীরা তাদের নিজের এবং অনাগত সন্তানের কল্যানের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে পারেন।
এসব আমলের পাশাপাশি সন্তানের সুস্থতার জন্য সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করতে হবে এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
রিলেটেডঃ গর্ভাবস্থায় সহবাস করার নিয়ম । ২০২৩
নেক সন্তান লাভের দুআ:
নেক সন্তান আল্লাহর এক বড় নেয়ামত। একজন গর্ভবতী মায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নেক সন্তান লাভের আমল। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে নেক সন্তান লাভের এই তিনটি আমল খুবই ফজিলতপূর্ণ।
১.‘রাব্বানা হাবলানা মিন আযওয়াঝিনা ওয়া জুররিয়্যাতিনা কুররাতা আইয়ুনা ওয়াঝআলনা লিলমুত্তাক্বিনা ইমামা।’
অর্থ: ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শ স্বরূপ করুন।
(সুরা ফুরকান : আয়াত-৭৪)
২.‘রাব্বি হাবলি মিল্লাদুংকা জুররিয়াতান ত্বাইয়্যেবাতান; ইন্নাকা সামিউদ দু’আ।’
অর্থ: ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তোমার পক্ষ থেকে পবিত্র সন্তান দান করো, নিশ্চয়ই তুমি দোয়া শ্রবণকারী।’
(সুরা আল-ইমরান : আয়াত-৩৮)
৩. ‘রাব্বি লা তাজারনি ফারদাও ওয়া আনতা খায়রুল ওয়ারিছিনা।’
অর্থ: ‘হে আমার রব! আমাকে একা রেখো না, তুমি তো শ্রেষ্ঠ মালিকানার অধিকারী (অতএব আমাকে উত্তম ওয়ারিশ/সন্তান দান করুন)
(সুরা আম্বিয়া : আয়াত ৮৯)
উপরোক্ত দোয়াগুলো নিয়মিত পাঠ করার মাধ্যমে একজন গর্ভবতী মা তার অনাগত সন্তানের জন্য আল্লাহর নিকট কল্যাণ প্রার্থনা করতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়
সন্তান গর্ভে ধারণ আল্লাহর পএক অপূর্ব নেয়ামত। সন্তানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ধরে রাখতে হলে গর্ভবতী মায়ের দৈনন্দিনের প্রতিটি আমল যথাযথভাবে আদায় করতে হবে।
উপরে বর্ণিত গর্ভবতী মায়ের আমল গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসন্তানের আশা করা যেতে পারে। আল্লাহ যেনো সকল মাকে নেক সন্তান দান করেন,আমীন।
সচরাচর জিজ্ঞাসা:
গর্ভবতী মহিলারা গর্ভের ১ম মাসে সুরা আলে ইমরান, ২য় মাসে সুরা ইউসুফ… এ ভাবে আমল করে। এটা কী সঠিক?
গর্ভাবস্থায় মহিলাদের জন্য বিশেষ কোন আমল কুরআন-সুন্নাহর দ্বারা প্রমাণিত হয় নি। তাই গর্ভ ধারণের প্রথম মাসে সূরা আলে ইমরান, ২য় মাসে সূরা ইউসুফ এভাবে আমল করলে তা বিদআতের অন্তর্ভূক্ত হবে। সুতরাং সূফী ও বিদআতীদের তৈরি করা এ ধরনের বানোয়াট ও ভিত্তিহীন আমল করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।
গর্ভবতী মহিলাদের নামাজের সময়ের ব্যাপারে কোন শীথিলতা আছে কি না?
নামাজ যেহেতু একটি ফরজ ইবাদত, তাই এটি সময়মতো আদায় করাই উত্তম। তবে গর্ভবতী মায়ের যদি সময়মতো নামাজ আদায় করতে সমস্যা হয় বিশেষ করে ফজরের নামাজের সময় যদি ঘুম না ভাঙ্গে তবে পরবর্তীতে সম্ভব হলে নামাজ কাযা আদায় করে নিতে হবে।